News:

Follow us

আত্মহত্যা এর ভয়াভহতা, মনস্তত্ত্ব ও প্রতিকার

আত্মহত্যার ভয়াভহতা, মনস্তত্ত্ব ও প্রতিকার  

ডিজি হেলথ এর তথ্য অনুযায়ী দেশে করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে ৮ই মার্চ ২০২১ পর্যন্ত করোনায় মারা গিয়েছিল ৮ হাজার ৪ শত ৬২ জন, সেখানে ঐ সময়ে আত্মহত্যা  করেছিল ১৪ হাজার ৪ শত ৩৬ জন (Aanchal Foundation)। বিশ্ব স্বাস্থ্য  সংস্থা (WHO) এর  হিসাব অনুযায়ী  প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। এ থেকে সহজেই অনুমেয় আত্মহত্যার প্রকোপ করোনার চেয়ে কতো ভয়াভহ।

আত্মহত্যা হচ্ছে কোনো ব্যক্তি  কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের  জীবন বিসর্জন দেয়া বা সেচ্ছায়  নিজের প্রাণনাশের  প্রক্রিয়া বিশেষ। ল্যাটিন ভাষার “সুই সেইডেয়ার” থেকে  আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে  যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। ডাক্তার  বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করার মানসিক অবসাদজনিত গুরুত্বর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।  অনেক ধর্মেই  আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে  বিবেচনা করা হয়।

প্রকোপ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর ২০২০ এর তথ্যমতে, প্রতি বছর  বিশ্বে  প্রায় ৮ লাখ মানুষ  আত্মহত্যা করে  এবং মৃত্যুর  হার প্রতি লাখে ১৬ জন।  পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২০ এর হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে  দেশের সবচেয়ে  বেশি মানুষ আত্মহত্যা  করে দক্ষিণ পশ্চিাঞ্চলীয় জেলা ঝিনাইদহে। ২০২০ সালের জানুযায়ী থেকে জুন এই ছয়মাসে ঝিনাইদহে মোট ১২০ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন।  সোসাইটি ফর ভলান্টরি  অ্যাকটিভিটিস (সোভার) এর মতে ঝিনাইদহে প্রতি লাখে  ২১ জন (আত্মহত্যার হার) এবং গড়ে প্রতিদিন ১ জন মানুষ আত্মহত্যা করে।

জাতীয় মানসিক  স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০২০ এর এক সমীক্ষা অনুযায়ী আত্মহত্যার হার শহরের তুলনায় গ্রামে ১৭ গুণ বেশি। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর যেসব কারণে  মানুষের  মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা এয়োদশ। নারীদের তুলনায়  পুরুষদের  মধ্যে আত্মহত্যার  হার প্রায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। কিশোর কিশোরী আর যাদের  বয়স ১৫-২৯ তাদের মৃত্যুর  ২য় প্রধান কারণ হল আত্মহত্যা। সারা পৃথিবীতে পুরুষদের  আত্মহত্যার প্রবণতা নারীদের  থেকে বেশি হওয়া স্বত্তে¡ও বাংলাদেশে  তার ব্যতিক্রম । বাংলাদেশে  নারীদের  আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষদের  চেয়ে বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন নারীদের সমাজের অবস্থান এবং পুরুষদের  উপর তাদের অর্থনৈতিক নির্ভরতা।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর  ২০২১ এর তথ্যমতে, করোনায় আত্মহত্যার হার বেড়েছে প্রায় ১৩%। নারীদের  আত্মহত্যার হার ৫৭ % এবং পুরুষের ৪৩ %। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে  আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। সমাজে যখন বিশৃঙ্খলা তৈরী হয় (কারো চাকরি নেই, কেউ স্বামী সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত, কেউ ব্যবসায়ী কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, কেউ আবার নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে এতটা চিন্তিত যে তাদের মানসিক  অবসাদ দেখা দেয়) তখন আত্মহত্যার হার বেড়ে যায় (Bhuiyan, et. al., 2020)।

আত্মহত্যার মনস্তাত্ত্বিক  কারণ 
একটি আত্মহত্যা সংগঠিত হতে হলে একাধিক কারণ সমন্বিতভাবে কাজ কাজ করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মতে ৯০% আত্মহত্যাকারীই কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যার কতগুলো কারণ নির্ণয় করেছে সেগুলো নীচে তুলে ধরা হলো:

১। বিষন্নতা (Depression): আত্মহত্যার এক নম্বর  কারণ হল বিষন্নতা। মর্ডান মেডিসিন বলে জেনেটিক কারণে অনেকে অন্যের চেয়ে বেশি ঝুকিতে থাকে বিষন্নতায় আরক্রান্তরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে। আর বাংলাদেশে বিষন্নতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪.৬%। শুধু বিষন্নতার কারণে ৪০ সেকেন্ডে ১ জন মানুষ আত্মহত্যা করে।

২। সিজোফ্রেনিয়াঃ সিজোফ্রেনিয়া হলো একটি Chronic মারাত্মক অসুখ, বিশ্বে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিজোফ্রেনিয়াকে আত্মহত্যার অন্যত্তম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিশ্বের প্রায় ৫% মানুষ এই সিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক রোগের কারণে আত্মহত্যা করে থাকে (WHO, 2021)।

৩। নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার জনিত অসুস্থতা (Substance use disorders): অ্যালকোহল, তামাক, ইয়াবা সহ অন্যান্য ক্ষতিকর নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার জনিত অসুস্থতার প্রভাবে ঝোকের বশে আত্মহত্যার চেষ্টা করে অনেকেই। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নেশা জাতীয় গ্রহন করে তাদের আত্মহত্যার ঝুকি সাধারণ মানুষ থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি। সকল আত্মহত্যার ৫০% সংগঠিত হয় অ্যালকোহল ব্যবহার  জনিত ডিসঅর্ডার এর কারণে (Miller and Gold, ১৯৯২)। আবার, অতিরিক্ত  ইয়াবা  সেবনের  ফলে তরুনরা “সাইকোসিস” নামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে যার প্রভাবে তারা রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা  হারিয়ে ফেলে যার ফলে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। মাদক থেকে  তরুন-তরুনীদের  ফিরিয়ে না আনা গেলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে দেশে  ভয়ংকর ধরনের অপরাধ “হোমিসাইড সুইসাইড” এর মতো  ঘটনা ঘটা বেড় যাবে।

৪। বাইপোলার ব্যাধি (Bipolar Disorder): বাইপোলার ব্যাধি যা ইংরেজিতে Bipolar Disorder  নামে পরিচিত। বাইপোলার ব্যাধি আত্মহত্যার প্রবণতা ১০-৩০ গুণ বেশি বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে ২০% রোগী আত্মহত্যায় জীবন দেয় এবং ২০-৬০% বাইপোলার ব্যধি দ্বারা আক্রান্ত রোগীরা জীবনে একবার হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করে (Dome, et. al., 2019)।

৫। পার্সোনালিটি  ডিসঅর্ডার: বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এ আক্রান্ত  ব্যক্তিরা নিজের ক্ষতি সাধন এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকে। তারা নিজেরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের হাত-পা কেটে নিজের ক্ষতি সাধন করে আবার অপরাধ করলেও তাদের অপরাধবোধ সৃষ্টি হয় না। এক পর্যায়ে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে ৮-১০% মানুষ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এর কারণে আত্মহত্যা করে (Paris, 2019)।

কিভাবে বুঝবেন কেউ আত্মহত্যা করবে কিনা?

আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন (APA)আত্মহত্যার বেশ কিছু লক্ষণ চিহ্নিত করে সে বিষয়ে সকলকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলেছে। এই লক্ষণগুলোকে নীচে আলোচনা করা হলো।

) মৌখিক হুমকি: কথা বার্তায় মৃত্যুর কথা, সাংঘাতিক লজ্জা বা অপমানের কথা, অপরের বোঝা হয়ে থাকার কথা বললে। যেমন- আমি তো বোঝা; আমি অলুক্ষণে; আমার জন্যে তোদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়; আমাকে ছাড়া তোমার সবাই ভালো থাকবে; এই সমাজে আমার কোনো প্রয়োজন নেই ইত্যাদি কথা আত্মহত্যার পূর্ব লক্ষণ।

) অনুভূতির প্রকাশঃ কিছু অনুভূতির প্রকাশ আত্ম হত্যার পূর্ব লক্ষণ বলে APA মনে করে।  যেমন- নিরাশা বোধ, ফাঁদে পড়েছি এমন অনুভূতি, বেচে থেকে লাভ নেই এমন অনুভূতি।  আবার সাংঘাতিক দুঃখ, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, বিরক্ত ক্ষোভের অনুভূতি প্রকাশ করা এবং আবেগীয় ও শারীরিক মারাত্মক কষ্টের অনুভূতি প্রকাশ করার মধ্যমেও আত্মহত্যার লক্ষণ প্রকাশ করে।

) আচরণের পরিবর্তনঃ  আচরণের কিছু পরিবর্তন যেমন- কিভাবে আত্মহত্যা করা যায় তার একটা পরিকল্পনা বা গবেষণা করতে শুরু করা। বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, রিক্সি কাজ  শুরু করা, অতিরিক্ত/ খুব কম খাওয়া ও ঘুমানো, নিজের চেহারার যত্ন না নেয়া প্রভৃতি। এছাড়া কম কথা বলা, নিজের প্রিয় জিনিসপত্র বা কারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এমন জিনিসপত্র ভেঙ্গে ফেলা, হঠাৎ জোড়ে জোড়ে চিৎকার করা বা একা একা  হাসা, পরিবারের সদস্যদের সাথে খারাপ আচরণ করা; ঘন্টার পর ঘন্টা একা একা সময় কাটানো ইত্যাদি আচরণ পরিলক্ষিত হওয়া।

) আত্মধ্বংসমূলক কর্মকান্ড: DSH (Deliberate Self Herm) বা Self injurious behavior এটি  আত্মহত্যার গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব লক্ষণ হিসেবে কাজ করে। যেমন; নিজেই নিজের শরীর প্লেট বা ধারালো  ছুরি দিয়ে কেটে ফেলা, অ্যালকোহল বা ড্রাগস গ্রহন, ঘুমের  ঔষধ খাওয়া ইত্যাদি। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া না করা এবং পরিমিত ঘুমের অভাব এই আত্মধ্বংসমূলক কর্মকান্ডকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

) একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা: অতীতে এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা বা Suicidal attempt এর কোনো ইতিহাস আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুন। গবেষণায় দেখা গেছে ৪০% থেকে ৬০ % আত্মহত্যাকারীরই অতীতে এক বা একাধিকবার Suicidal attempt এর ইতিহাস থাকে (American Foundation for suicide prevention)।

আত্মহত্যা হতে বাঁচানোর উপায়
আমরা যদি বুঝতে পারি যে কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করছে তাহলে নিচের পরামর্শগুলো মেনে ঐ ব্যক্তিকে আত্মহত্যা হতে বাঁচাতে পারব।

১। কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বা আত্মহত্যা করবে তা বুঝতে পারলেই তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের নিকট পাঠাতে হবে।

২। আত্মহত্যার দিকে ধাবিত ব্যাক্তিকে কখনোই  দোষারোপ করা যাবে না এবং কোনোভাবেই একা ছেড়ে যাবেন না। সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবেন।

৩। আপনি যদি বুঝতে  পারেন আপনার  আশেপাশের কেউ একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করছে বা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে তাকে অবহেলা না করে একটু বেশি সময় দেয়ার চেষ্টা করুন। সব কাজে তাকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করুন। আপনার একটু সময় এবং গুরুত্ব দেয়ার মাধ্যমে বেঁচে যেতে পারে একটি সম্ভাবনাময় প্রাণ।

৪। আত্মহত্যার হুমকি একেবারেই হাল্কাভাবে নেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বরাবরই জোড় দেন। আত্মহত্যা করতে গিয়ে যারা বেঁচে ফিরে তারা স্বাভাবিকভাবেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না।

পরিশেষে, আগামী ১০ই সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। এই দিবসকে সামনে রেখে আসুন আত্মহত্যা সম্পর্কে আমরা নিজে জানি অপরকে জানাই, নিজে সচেতন হই অপরকে সচেতন করি এবং সবাই মিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করি সুস্থ্য সুন্দর জীবন গড়ি।

লেখকঃ শেখ আব্দুল্লাহ, ২য় বর্ষ, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

4 Responses

  1. Your article was more informatively than others.Everyone should be more carefully in his/her life then we can save our life from accidental death(suicide)

  2. Your article was more informatively from others. Everyone should be more carefully in his/her life then we can save our life from accidental death(suicide)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Search