News:

Follow us

জীবনসঙ্গী নির্বাচন

জীবনসঙ্গী নির্বাচন (Life Partner Selection)

কুড়িতে বুড়ি। কুড়ি পেরোবার অনেক আগেই মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ছিল একসময়। আমাদের দেশে বিয়ে হতো অভিভাবকের ইচ্ছায়। জীবন সঙ্গী নির্বাচন (Life Partner Selection) করতেন তারাই। ভালো ছেলে বা ভালো মেয়ে কখনো নিজের পছন্দ প্রকাশ করেনা। তারা আসলে কিছু বুঝেইনা। তাদের বুঝতে নেই। তারা বলবে-‘আমার বাবা-মা যাকে ভালো বলবেন আমি তাকেই পছন্দ করবো’। কিন্তু এখন দুই হাজার বিশ সাল। অভিভাবকেরাও অনেক সময় বাচ্চাদেরকে পছন্দ করার সুযোগ দিচ্ছেন। নিজেরা পছন্দ করার পর শেষ সিদ্ধান্ত তাদেরকে নিতে দিচ্ছেন কেউ কেউ। গত কয়েক দশক ধরে ক্রমবর্ধমান হারে তরুণ তরুণীরা নিজেরাই বেছে নিচ্ছে (বা বেছে নেবার জোড় চেষ্টা করছে) নিজের জীবন সঙ্গী/সঙ্গীনী। এই বাছাই প্রক্রিয়ায় নানা ধরণের অভিজ্ঞতা হচ্ছে।

কখনো সুখের ঠিকানার সন্ধান মিলছে। কখনো শুরু হচ্ছে অশান্তি। জোড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। আধুনিক দেবদাশ (মহিলা দেব দাশ/দেব দাশী?) কিছুদিন কষ্ট পাচ্ছে। আবার শুরু করছে নতুন করে। কেউ কেউ হতাশার আবর্তে নিজেকে ধ্বংস করে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ চলে যাচ্ছে নেশার জগতে। পুরাতন বাংলা মদের দিন শেষ। চলছে ইয়াবা না হয় ফেন্সিডিল বা হিরোইন। কি এক জীবন! নিজের প্রতি নিজের মায়া ছাড়া কেউ থাকেনা  দুটো ব্যথার সঙ্গী হবার। আপনজনেরা পর্যন্ত বিরূপ। কেউ কেউ পছন্দ করে বিবাহ করে ফেলেন। যদি সব ঠিক থাকে তবে আলহামদুলিল্ল্হা। কিন্তু যদি ঠিক না থাকে তবেই বিপদ। জীবন ব্যপী চলে গৃহযুদ্ধ। আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদকে সহজভাবে নেয়া হয়না। বাবা-মার পরিষ্কার কথা-নিজের পছন্দে বিয়ে করেছ। এখন সামলাও।আমাদের পরিবারের কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ করেনি। এমন খরাপ নমুনা আমাদের পরিবারের জন্য কলঙ্ক। এটা চলবেনা। পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠে।

‘ভাবিয়া করিয়ো কাজ করিয়া ভাবিয়োনা’। বহু পুরাতন প্রবাদ। ভাবুন। অনেক করে ভাবুন। তারপর জীবনসঙ্গী/ জীবন সঙ্গীনী বেছে নিন (Life Partner Selection) । বিশেষ বিবেচনার জন্য নিচের টিপস গুলো পেশ করছি।

১. ‘নো দাইসেলফ’

‘নো দাইসেলফ’- দার্শনিকের সেই বিখ্যাত উক্তি। আমি কি চাই তা বুঝে আমাকে তেমন জীবন সঙ্গী/সঙ্গীনী  খুজতে হবে। তবে চাহিদার সবই যে আমি পাব এমন কথা নেই। কোন চাহিদাগুলো না হলে আমার একদম চলবেনা তাও ঠিক করে নিতে হবে। আমার সঙ্গী/সঙ্গীনী আমার থেকে কি আশা করছে এটাও বুঝে নিয়ে মোটামুটি একটা সমঝোতার ভিত্তিতে সঙ্গী/ সঙ্গীনী বাছাই (Select Life Partner) করা যেতে পারে।

২. বিবেচক

আমার সম্ভাব্য সঙ্গী সাহনুভূতিশীল, মর্যাদাবান, সৎ, নির্ভরযোগ্য, দয়ালু, ও বিবেচক হলে ভাল হয়।

৩. আবেগের নিয়ন্ত্রণ

তার নিজের আবেগের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। রেগে মেগে কাউকে মেরে দিলাম বা ভাঙচুর করলাম। চোখের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম বা চুল ধরে ঝুলে পড়লাম। দিলাম একটা ভয়ানক খামচি। রশি নিয়ে ঝুলে পড়ার চেষ্টা করলাম- এমন হওয়া একদম চলবেনা। এধরণের মানুষের দরকার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা। ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেবার চিন্তা আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

৪. পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য

যে বৈশিষ্টের কারণে আপনি তাকে এতো পছন্দ করছেন বিবাহের পরও সেই বৈশিষ্ট্যটি কি আপনি পছন্দ করবেন? এক বোকা মেয়ে পটানো প্রেমিকের প্রেমে পড়ে গেল। লক্ষ্য করে দেখুনতো এই লেডি কিলার (ভিন্ন লিঙ্গের হলে ম্যান ইটার) কি শুধু আপনার সাথেই এমন করে না বিপরীত লিঙ্গের হলেই হলো। বান্দা সত্য বলে কিনা লক্ষ্য করে দেখুন। প্রেমের সাগরে ভেসে কান্নার সাগরে ডুববেননা যেন। ঘাড়ের উপর যে গোলাকার বস্তুটি আছে তার প্রয়োগ করা বিশেষ ভাবে দরকার।

৫. সামাজিক দক্ষতা

সম্ভাব্য সঙ্গীর সামাজিক দক্ষতা ভাল হওয়া দরকার। সে যাতে নিজেকে ভাল ভাবে প্রকাশ করতে পারে ও আপনাকেও ঠিকমতো বুঝতে পারে।

৬. প্রত্যাশিত আচরণ

বিবাহিত জীবন ও জীবন সঙ্গীর থেকে সে কি ধরণের আচরণ আশা করে তা ঠিকমতো আলাপ করুন। তার মুখের কথা যথেষ্ঠ নয়। তার আচরণ ও তার জীবন-যাপন প্রণালী লক্ষ্য করুন। অসতর্ক মুহুর্তে কথা, ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে তার কল্পনা এসব তার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরী করতে সাহায্য করবে। আপনি কি তার এই চাহিদা গুলো পূরণে প্রস্তুত আছেন? ওর জন্য সব করতে পারেন?  আপনার নিজের পরিবারে আপনি কি এমন কাজ গুলো করছেন? কিছুদিন করুন। দেখুন ভাল লাগে কিনা। সময় এলেই করবেন? তখন ঠিকই পেরে যাবেন? হাসালেন! আপসোসে জীবন ভরে উঠবে।

৭. উদারতা

তার মধ্যে উদারতা আছে কিনা? নাকি সে খুব গোড়া ধরণের? কোন পরিবর্তন একদম মানতে পারেনা। আপনি কি চান। যদি চান সে আপনাকে অনেকটা স্বাধীনতা দিক,  সে আপনার সাথে আলোচনা করে সংসারের সিদ্ধান্তগুলো নিক তবে তার সাথে কথা বলুন। আপনি পড়তে চান বা আপনি চাকুরী করতে চান – ভাল কথা। ওর সাথে কথা বলুন। বুঝে নিন ও কি চায়। বাচ্চা কখন নিবেন তাও আলাপ করুন।

৮. নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

সে আপনাকে কতটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তা লক্ষ্য করুন। ‘ও আমার প্রেমে পাগল। আর কারো সাথে সামান্য কথা বললেও ও জেলাস হয়ে মিস বিহ্যাব করে’- এমন ধরণের কথা বলবেননা। বিয়ের আগেই যদি এতটা পজেসিভ হয় তবে পরে কেমন হবে ভাবুনতো। কখনো কোন কারণেই আপনাকে যদি আঘাত করে তবে বিয়ের পরে তা বহুগুণে বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। পাগল প্রেমিক চোখ নাচিয়ে বললো- ‘আমার সাথে প্রেম করার আগে ভেবে দেখ। আমার গভীর প্রেম। যদি ভবিষ্যতে তুমি সম্পর্ক ছিন্ন কর তবে তোমার ধর থেকে মাথা ছিন্ন করে দিব।’ বলেই আবার পাগল সুলভ নির্দোষ (আসলে দ্বিধা সৃষ্টিকারী)হাসি দিল। সাবধান! ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়োনা।

৯. মায়া বনাম ভালোবাসা

মায়াকে ভালোবাসার সাথে গুলাবেননা। ভালোবেসে ওর মাদকাসক্তি ভুলিয়ে দিবেন। মাথার থেকে সুচিত্রা সেন/ দ্বীপ জ্বেলে যাই – দূর হলোনা দেখছি। মাদকাসক্তির বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে। একই কথা মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেও। ভালো হয় তার উপযুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করলে।

১০. ভূমিকা

স্বামী বা স্ত্রীর কার কি ভূমিকা এবিষয়ে আপনার সঙ্গী কি ভাবে জিজ্ঞাসা করুন। স্ত্রী অন্যায় করলে স্বামী তাকে কতটুকু শাসন করতে পারেন বলে সে মনে করছে? এই উত্তরের সাথে আপনার প্রত্যাশা মেলান।

১১. বাস্তবতা

কতগুলো বাস্তব বিবেচনাও মাথায় রাখা ভাল। আয়-রুজির উৎস কি হবে, জীবনের মান কেমন হবে, কার সাংস্কৃতিক পটভূমি কেমন?  একজন আওলা বাউল আর আরেকজন গান সহ্যই করতে পারেনা,  একজন পরকালের বাসিন্দা (মানসিক ভাবে আরকি) আর অন্যজন ইহকালে একদম আসক্ত হয়ে আছে এমনটা হওয়া ভাল নয়।

ভাবুন, বিবেচনা করুন। নিজেকে বুঝুন। নিজেকে ঠকাবেননা। জোড় করে মহাপুরুষ সাজার দরকার নেই। প্রত্যাশা করি সবার মনের মতো সঙ্গী/সঙ্গীনী হোক। জীবন ভরে উঠুক পূর্ণতায়। সুখী হোন।

লেখকঃ মোঃ জহির উদ্দিন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Search