ভাই, কানাডাতে কেন আসলেন? উত্তর, বাচ্চাদের ভবিষ্যতের জন্য। ধরুন মিঃ সাইফুল কানাডাতে আসলেন জীবনের এমন একটা সময়ে, যখন তার নতুন করে শুরু করা জটিল, আবার তার বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এবং লেখাপড়া চাকুরি পাওয়াও কঠিন। বাংলাদেশে ছিলেন একজন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। শুধুমাত্র বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে কানাডাতে আসা। আসার পর আরেক ঝামেলা, চারিপাশে শুনেন ওর দুইটা বাড়ি, ওর ঐ ব্রান্ডের গাড়ি, ওর এত ভালো চাকুরি, ও এই করেন, ঐ করেন, জীবনে সফল হতে হবে, সে কি এক মানসিক চাপ সব সময়। নিজে যেহেতু ভালো অবস্থানে ছিল, এই সব শুনলে মনে মনে নিজের প্রতি রাগ হয়, আবার ভাবেন যাক ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ বলে কথা।
নিজে অনেক কিছু করার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয়ে কোনমতে চলার মত একটা চাকুরি করে চলছেন। এরই মধ্যে আবার ছেলে মেয়ে কবে বড় হয়ে গেছে, খেয়াল করেননি। নিজে ব্যস্ত থাকার কারনে বাচ্চাদের এবং পরিবারকে সেভাবে সময় দিতে পারেনাই। হটাত খেয়াল করলেন, তার একমাত্র ছেলে কেমন যেন আচরণ করা শুরু করছে। একদিন জানতে পারলেন, তার ছেলে কি সে যেন আসক্ত। চক্ষু লজ্জার ভয়ে কাউকে বলতে পারেন না। যদি মানুষ জানে, তাহলে সর্বনাশ, তাদের এক ঘরে করে রাখা হবে, কেউ তাদের সাথে মেলামেশা করতে চাইবেনা। মা, ব্যপার টা অনেক দিন ধরে খেয়াল করছেন, কিন্তু সেই সম্পর্কে কোন বাস্তব ধারনা না থাকার কারনে কিছু বলেন নি, পক্ষান্তরে মা ভেবেছেন এসব বয়সের দোষ, কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে, আবার কখনও কখনও ভেবেছেন বিয়ে দিলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। মা আবার অনেক সময় অতিরিক্ত আদর করতেন, নিজে খাইয়ে দিতেন, রাগ করলে কিছু বলতেন না। একদিন হটাত তার আদরের সন্তান পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যায়, না ফেরার দেশে।
কানাডাতে তরুন মৃত্যুর মুল দুইটা কারন হল, আত্মহত্যা এবং মাদকে আসক্তি। কানাডা সহ উন্নত বিশ্বে প্রতি বছর অসংখ্য তরুন তুরুনি এই আত্মহত্যার বা আসক্তির কারনে মারা যায়। আসক্তি অনেক ধরনের হতে পারে। তবে কানাডাতে ইদানিং খুব আলোচনায় আসেছে Fentanyl crisis। আগে শুনেছি Vancouver এই সমস্যা ব্যপক হারে ছিল, তবে ইদানিং টরেন্টো খুব বেশি শোনা যাচ্ছে।
Fentanyl কি? বা Fentanyl crisis কি? এই সম্পর্কে আমাদের, বিশেষ করে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে খুব বেশি সচেতন বলে মনে করিনা। বিষয়টা খুব ভয়ানক এবং আবার জানা জুরুরি মনে করি, বিশেষ করে কানাডাতে যাদের উঠতি বয়সী ছেলে মেয়ে আছে। টরেন্টো বেশ কয়েকদিনে ২৭ টা মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৪ জনের মত Fentanyl এর অভারডোজ এর কারনে। এটা এমন একটা ক্রাইসিস যা সহজে বুঝা যায়না। হটাত করে এর ব্যপকতা দেখা যায়। আমাদের বাংলাদেশি অভিবাসীদের ছেলে মেয়েরা খুব বেশি এই ক্রাইসিস এর মধ্যে আছে বলে মনে হয়না, তবে আমরা কেউ জানিনা কখন যে কার এই সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশে যেমন ইয়বা চলছে, কানাডাতে ঠিক তেমনি Fentanyl crisis।।
আমি এই ফিল্ড এ কাজ করার বদৌলতে একটু ধারনা আছে, তবে খুব বেশি কিন্ত জানিনা। তাই গুগলের সাহায্য নিয়ে যা জানলাম, “Fentanyl is a powerful synthetic opioid analgesic that is similar to morphine but is 50 to 100 times more potent” (NIDA-2017). সহজ করে বলা যায়, আমরা যখন ব্যথা অনুভব করি তখন ব্যথানাশক ঔষধ খেলে ব্যথা চলে যায়। অনেকে বাচ্চা জন্মের সময় ব্যথানাশক ইনজেকশন নেয়, আবার অনেকে বড় ধরনের সার্জারি এর পর ব্যথানাশক ঔষধ দেয়া হয়, কিন্তু এটা হল এক ধরনের ঔষধ যা অনেক শক্তিশালী এবং অবশ্যই অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করা হয়, ডাক্তার এর অনুমোদন ছাড়া । অনেকে আবার ডাক্তার এর অনুমোদন নিয়ে শুরু করে, কিন্ত যখন আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন ডাক্তার এর ধার ধারেনা। অনেক দামি, তাই সকলে কেনার সামর্থ্য রাখেনা। তবে ইদানিং নাকি চাইনিস জিনিস পাওয়া যাচ্ছে অবৈধ উপায়ে, সস্তা তবে ভেজাল। যার কারনে অনেকে অকালে অভারডোজ এ মারা যাচ্ছে। অনেক নামে এটা পাওয়া যায়, যেমন Apache, China Girl, China White, Dance Fever, Friend, Goodfella, Jackpot, Murder 8, TNT, and Tango and Cash ইত্যাদি।
কেউ আসলে Fentanyl crisis এ আসক্ত কিনা তা সহজে বুঝা যায়না। তাদের মাঝে আসক্তির সকল লক্ষন দেখা যায়, দেরিতে ঘুম থেকে উঠা, মানুষকে এরিয়ে চলা, মাথা ব্যথা, ক্ষুদামন্দা, ঘুম কম হওয়া, ওজন কমে যাওয়া সহ অনেক লক্ষন দেখা যায়। যারা এই সমস্ত জিনিসে আসক্ত তারা তাদের আসক্ততার জন্য অনেক ধরনের জঘন্য কাজ ও করতে পারে। চুরি, অসাধু উপায়ে আয়, কর্ম ক্ষেত্রে অসাধু কাজ অর্থাৎ তাদের সে জিনিস কেনার জন্য যা দরকার, তাই করতে পারে।
এর থেকে উত্তরনের উপায় কি? টরেন্টোতে ইদানিং সিটি মেয়র সহ প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইন উদ্বিগ্ন (anxiety) এর সমাধান এবং প্রতিরোধে। আমার বাংলাদেশি কমিউনিটি এর ছেলে মেয়েরা কতটা এগুলোর সাথে জড়িত, তা জানিনা, তবে আমি বাংলাদেশির মত অন্য কমিউনিটিতে কিন্তু এটা একটা ক্রাইসিস হিসাবে দেখছে। আমাদের দরকার সচেতনতা আর আমাদের ছেলে মেয়েদের সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক। আপনি একটু ভেবে দেখেন তো, সর্বশেষ কবে আপনার উঠতি বয়সি ছেলে মেয়ের সাথে ১০-১৫ মিনিট একটু মাইন্ডফুলি কথা বার্তা বলেছেন। হাজার হলেও আমরা কেউ চাইনা, আমাদের ছেলে মেয়েরা এই পথে পা বাড়াক। যদি আপনি এই ধরনের কোন কিছু সন্দেহ করেন, তাদের সাথে কথা বলুন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিই।
উপরের গল্পটা কাল্পনিক, তবে অনেকের সাথে মিলে যেতে পারে। আমি অনেক জনের ব্যপারে জানি, তবে ভাগ্য ভালো তারা কেউ বাংলাদেশি অভিবাসি বা অভিবাসীর ছেলে মেয়ে না, কিন্ত কতক্ষণ? আসুন আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের সাথে আন্তরিক এবং সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করি এবং প্রয়োজনে ছেলে মেয়েদের সাথে কিভাবে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক করা যায় তা জানি এবং প্রয়োজনে অন্যের সাহায্য নেই এই সম্পর্ক তৈরি এবং এর ভয়াভয়তা, প্রতিকার, বা সমাধান জানতে।
লেখক- সাইফুল ইসলাম, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী, টরেন্টো, কানাডা।