News:

Follow us

চিন্তায় বিকৃতি -Cognitive Distortion

চিন্তার বিকৃতি কি?

চিন্তার বিকৃতি (Cognitive Distortion) হল মানুষের অভ্যাসগত এমন এক ধরনের অযৌক্তিক নেতিবাচক চিন্তন যা মোটেও সত্য নয়। এই ধরনের চিন্তার বিকৃতিগুলো সাধারণত আবেগগুলোকে শক্তিশালী করতে মানুষ ব্যবহার করে। চিন্তার বিকৃতির এই ধরনগুলোর কারনেই মানুষ কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে, আত্ম মর্যাদা কমে যায়, এবং মানসিক সমস্যা যেমন দুঃচিন্তা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং মাদকাসক্তে আক্রান্ত হয়ে পরে। কগনিটিভ বিহ্যাভিয়ার থেরাপি (CBT)চিকিৎসায় ক্লায়েন্টকে এই বিকৃতিগুলো চিনতে শিখানো হয় এবং সেই চিন্তনগুলোকে সহায়ক ও বাস্তব ধর্মী চিন্তন দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা করা হয়।

কিছু চিন্তার বিকৃতি (Cognitive Distortion) নীচে আলোচনা করা হল।

১) Mental Filtering (মানসিক ছাকনী): দুই ধরণের মানসিক ছাকনি মানুষ ব্যবহার করে।
ক) নেতিবাচক মানসিক ছাকনী- এতে ব্যক্তি শুধু একটি ঘটনার নেতিবাচক দিকে মনোযোগ দেয় এবং সেগুলোকে অনেক বড় করে দেখে। যেমনঃ একজন চাকুরীজীবী তার কাজের ভালো একটা রিভিউ প্রতিবেদন পেল তারপর ঐ ব্যক্তির মনোযোগ শুধু ম্যানেজারের একটা নেতিবাচক মন্তব্যের দিকেই রয়ে গেল। খ)ডিসকোয়ালিফায়িং দ্য পজিটিভ / ইতিবাচক চিন্তাকে অযোগ্য করা – এরা ইতিবাচক চিন্তাকে স্বীকার করে কিন্তু তা গ্রহণ করে না। কোন একটি অজুহাতে তা ইতিবাচক চিন্তাকে নেতিবাচক চিন্তায় পরিনত করে। যেমনঃ একজন ছাত্র পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে বলতে থাকে তার কপাল ভালো ছিল বিধায় রেজাল্ট ভালো হয়েছে এটা তার কঠোর পরিশ্রমের ফল নয়।।

২) Polarization(মেরুকরণ): এ ধরনের চিন্তার বিকৃতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবকিছুকে চরম মাত্রায় চিন্তা করে। এধরনের চিন্তাকে অল-অর-নাথিং (All-or-Nothing) অথবা সাদা এবং কালো (Black and White) চিন্তাও বলা হয়ে থাকে। এদের মনে হয় সব কিছু নিখুঁত হতে হবে তা না হলে সব ব্যর্থ। এদের কাছে মধ্যবর্তী বলে কিছু নেই। যেমনঃ একজন ছাত্র পরীক্ষায় A- পেয়েছে। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে সে ফেল করেছে কারণ, তার A+ ছারা অন্য কোন গ্রেড পাওয়ার কোন অর্থ নেই। এদের মানসিকতা হলো- “আমি যা করি তার সবকিছুতে যদি সাফল্য না পাই, তাহলে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ”।

৩) Overgeneralization: দুই একটা উদাহরণ দেখে বাকি অন্যান্য সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কে একই ধারণা করে নেওয়া। এখানে ব্যক্তি একটি ঘটনার দিকে মনোযোগ দেয় এবং একটি নেতিবাচক ঘটনার উদাহরণ থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যেমনঃ একজন ছাত্র একটি পরীক্ষায় খারাপ করল, এর উপর ভিত্তি করে, সে ভাবতে থাকে যে, সে একজন নির্বোধ/বোকা এবং ব্যর্থ। সে আরো বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, ভবিষ্যতে সে যে পরীক্ষা দিবে সবগুলোতেই সে খারাপ করবে।

৪) Jumping into Conclusion: এই ধরনের চিন্তার বিকৃতি দু রকমের। ক) অন্যের মন বুঝতে পারা (Mind reading)– ব্যক্তি মনে করে যে অন্যেরা মনে মনে কি ভাবছে তা সে বুঝতে পারে আসলে তা বাস্তব সম্মত নয়। অনেক সময় মনে হয় অন্যরা আমার সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু ভাবছে। যেমনঃ সবাই আমাকে ঘৃণা করে কারণ আমি মোটা। আবার, সে ভাবছে যে, আমি এই প্রজেক্টের প্রাথমিক বিষয়গুলি জানিনা। খ) ভবিষ্যৎ বলে দেয়া (Fortune Telling)– কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ঘটনা ঘটার পূর্বেই নেতিবাচক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। যেমনঃ আমার মন এতটাই খারাপ হয়ে যাবে যে, কোন কাজই ঠিকভাবে করতে পারব না।

৫) Catastrophizing (বিপর্যায়ের আশংকা): এই ধরনের চিন্তার বিকৃতির ব্যক্তিরা কোন ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখে অর্থাৎ তারা সামান্যতে বড় দূর্যোগে বা বিপদে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করে। অন্যভাবে বলা যায় কোন ঘটনা শুনলে এরা সেটার নিকৃষ্টতম ঘটনা কল্পনা করে। এখানে ব্যক্তির উদ্বেগের মাত্রা এতটাই অতিরঞ্জন থাকে যে এখনই সবচেয়ে খারাপ কিছু ঘটবে বলে মনে করে। যেমনঃ আমি যদি আজকের এই পরীক্ষায় পাশ না করি তাহলে, আমি কখনোই স্কুল পাশ করতে পারব না এবং আমার পুরোজীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে অথবা নৌকা ভ্রমণের সময় সামান্য ঢেউএ নৌকা দোলাদুলি করার সময় মনে করবে, এই বুঝি নৌকা ডুবে যাবে এবং আমি নিশ্চিত মারা যাব।
ক) Magnification – এক্ষেত্রে কেউ নিজের, অন্যের বা কোন ঘটনার মুল্যায়ন করার সময়, যুক্তিহীনভাবে নেতিবাচক বা অপ্রয়োজনীয় বিষয় যেমন কোন একটি ভুলকে অনেক বড় করে দেখে। যেমনঃ আমার গড়পড়তা কর্মদক্ষতা প্রমাণ করে আমি কতটা অদক্ষ।
খ) Minimization – এখানে ব্যক্তি ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোকে ছোট করে দেখে অর্থাৎ ব্যক্তি ইতিবাচক গুণগুলোর গুরুত্ব কম দেয়। যেমনঃ আমি পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছি মানেই আমি মোটেও ভাল ছত্র নই।

৬) Personalization (ব্যক্তিগতভাবে নেয়া): এই ধরনের বিকৃতিতে ব্যক্তিরা সবকিছুই ব্যক্তিগতভাবে নেয়। অর্থাৎ সব খারাপ ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করে এবং দোষ না করেও নিজেকে দোষী মনে করে। এমনকি বিষয়টা ঐ ব্যক্তির নিজের সাথে সম্পর্কিত না হলেও ব্যক্তি তা নিজের মনে করে নেয়, ঐ আচরণের যথার্থ ব্যখ্যা বিবেচনা না করে। যেমনঃ কাট মিস্ত্রি আমার সাথে কম কথা বলেছে মানে নিশ্চই আমি কোন ভুল করেছি। আবার, বিয়ে বাড়ি থেকে কিছু চুরি যাওয়ায় কেউ একজন বলল যে, যারা বিয়ে বাড়িতে এসেছিল তাদের মধ্যে থেকে কেউ চুরি করতে পারে। এমন কথায় চুরির জন্য ঐ ব্যক্তি নিজেকে সরাসরি দায়ী করা হচ্ছে মনে করবে।

৭) Blaming (দোষারোপ): এই ধরনের চিন্তার বিকৃতির ব্যক্তিরা সর্বদা নিজের কষ্ট কিংবা দুর্ভাগ্যের জন্য অন্যেকে দোষারোপ করে। এমনকি নিজের ভুলের জন্য অপরকে দায়ী করে। উদাহরণস্বরুপ- আমাকে কেউ বুঝে না তাই আমার এত কষ্ট।

৮) Should and must Statement: এই বিকৃতিতে ব্যক্তি মনে করে, এটা করা উচিৎ, ওটা করা উচিৎ না এবং এটা অবশ্যই করতে হবে। এরা নিজে কিংবা অন্যরা একটা নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে কোন আচরণ করলে তা মেনে নিতে পারে না। অন্যেরা প্রত্যাশিত নিয়মে আচরণ না করলে যেমন তাকে দোষী মনে করে তেমনি, এরা নিজস্ব কোন নিয়ম ভঙ্গ করলেও নিজেকে দোষী মনে করে। এধরণের নিয়ম-নীতি ব্যক্তির উপর প্রচন্ড উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা তৈরি করে। যেমনঃ আরিশা কোন রকম ভুল ছাড়াই গানের সাথে গীটার বাঁজাতে চায়। যখন সে কোন ভুল করে তখন নিজের উপর তার প্রচন্ড রাগ হয় এবং নিজেকে তুচ্ছ মনে করে কান্নাকাটি করে। যার ফলশ্রুতিতে, গীটার প্র্যাকটিস করাই বন্ধ করে দেয়।

৯) Emotional Reasoning: এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেকে মূল্যায়ন করে তার আবেগীয় পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে। যেমনঃ শামীম তার আবেগীয় অবস্থার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত আসলো যে, সে একজন মূল্যহীন ব্যক্তি, আর এই পরিস্থিতি তাকে প্রচুর অতিরিক্ত খাবার খেতে (binge eating) বাধ্য করছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি যখন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, তখন সে ধরেই নেয় সত্যিই তার আবেগগুলো বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে। যেমন- “আমি ষ্টুপিড ও বোরিং অনুভব করছি, মানে সত্যিই আমি ষ্টুপিড ও বোরিং” অথবা- যদি কারো নিজেকে অপরাধী হওয়ার অনুভূতি তৈরি হয় তবে, সে ভাবতে থাকে যে, সে সত্যি সত্যি একজন খারাপ ব্যক্তি।

১০) Control Fallacy: এই ধরণের বিকৃতি দুই ধরণের বিশ্বাস দ্বারা ব্যখ্যা করা যায়- একটি অভ্যন্তরীণ (Internal Control Fallacy) এবং অপরটি বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ (External Fallacy)।
ক) অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ (Internal Fallacy)– এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি মনে করে যে তার নিজের এবং তার চারপাশের উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই বিশ্বাস অনুযায়ী সে মনে করে যে নিজের এবং চারপাশের লোকদের বেদনা এবং সুখের অনুভুতির জন্য তিনি নিজেই দায়ী। যদি কেউ খুশি না হয়, তবে এরা ধরে নেয় এটা তারই দোষ এবং তার কারনেই অন্যরা কেউ সুখী নয়। উদাহরণ স্বরূপ- আপনার একজন সহকর্মী কর্মক্ষেত্রে একটি কাজে প্রযুক্তিগত ভুল করে। এই ভুলের জন্য কাজে বেশ ক্ষতি হয়। এ ক্ষতির জন্য আপনি নিজেকে দোষী মনে করতে শুরু করলেন, কারণ আপনি সহকর্মীর কাজের ভুলটি আগে খেয়াল করেননি।
খ) বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ (External Fallacy)– এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি মনে করে মানুষের জীবন বাইরের উপাদান এবং ভাগ্য দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত এবং নির্ধারিত হয়ে আছে। এতে এই অনুভূতি তৈরি হয় যে পরিস্থিতির উপর তার একেবারেই কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যদিও প্রকৃতপক্ষে কিছু কিছু পরিস্থিতিতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। উদাহরণ স্বরূপ- একজন ব্যক্তি তার প্রেমিকার সাথে প্রতারণা করে এবং মিথ্যা বলে। যার দরুন একসময় সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় কিন্তু ঐ ব্যক্তির মনে করতে থাকে এই ঘটনায় তার কোন হাত নেই।

১১) Fallacy of Change: এই ধরনের বিকৃতির ব্যক্তি আশা করে যে, অন্য ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করলে  সে তার উপযুক্ত হয়ে উঠবে কারণ নিজের সাফল্য ও সুখের জন্য তার প্রত্যাশা পুরোপুরি অন্য ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল। যেমন- অনেক স্ত্রী এই বিশ্বাস করে যে,  তার স্বামীর চেহারা ও আচরণের উন্নতি করতে চেষ্টা করলে, এই ছোট খাটো কয়েকটি জিনিষের পরিবর্তন তাদের সুখী করবে।

১২) Global labelling: এটা ওভারজেনারালাইজেশনের একটি চরম রূপ। এ ধরণের বিকৃতিতে, একজন ব্যক্তি নিজের বা অন্যের ভুলের পরিবর্তে, একটি নেতিবাচক ঘটনার উপর ভিত্তি করে নিজের বা অন্যের মূল্যায়ন করে। উদাহরণস্বরূপ- একটি কাজে এক সহকর্মীর কাছে সহযোগিতা চাইলেন, কিন্তু সে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানাল। এই একটি ঘটনার উপর ভিত্তি করে আপনি তাকে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, ছোট মনের মানুষ মনে করতে শুরু করলেন। প্রকৃত পক্ষে ঐ ব্যক্তি হয়ত তার কাজ নিয়ে সাংঘাতিক চাপে রয়েছে। এক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে যেমন- জাপানি সুপ খেতে একজনের খারাপ লাগলো, সে বলবে জাপানি সব খাবারই খারাপ।

১৩) Always being Rights (সর্বদা সঠিক হওয়া): এই ধরনের বিকৃতিতে ব্যক্তিরা নিজেকে সব সময় সঠিক হতে হবে মনে করে। তাই এরা নিজের মতামত ও কাজগুলিকে সবসময় একদম সঠিক মনে করে এবং সর্বদাই নিজেকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টায় রত থাকে। এই অযৌক্তিক চিন্তনের ব্যক্তিরা কখনও ভুল করতে পারেনা বলে ধারণা করে তাই ভুলকে মেনে নিতে পারে না। যেমন- ইন্টারনেট মন্তব্যকারীরা যারা একটি মতামত বা রাজনৈতিক ইস্যুতে একে অপরের সাথে তর্ক করে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করে যেখানে যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তিরা ‘একমত’ কিংবা ‘দ্বিমত’ যেকোন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিৎ মনে করে। কিন্তু “সর্বদা সঠিক হওয়া” বিকৃতিতে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে, এটি কেবল মতের পার্থক্যের বিষয় নয়, এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ যা যে কোনও মূল্যে জিততেই হবে।

এই ধরনের কোন চিন্তায় বিকৃতি (Cognitive Distortion) থাকলে কগনিটিভ থেরাপি দিয়ে এ সমস্যা থেকে বের হওয়া যায়। আপনার বা প্রিয়জনের চিন্তায় বিকৃতি হলে দ্রুত মনোবৈজ্ঞানিক সহায়তা গ্রহন করুন ও চিন্তার বিকৃতি দুর করুন।

লেখকঃ ডঃ মোঃশাহীনুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Search